বাংলাদেশ অর্থনীতির গত ৫ বছরের উত্থান-পতন, সমস্যা ও সমাধান : একটি অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ

Date: 2023-12-04
news-banner

বার্তা বিচিত্রা সর্বশেষ সংবাদ পেতে Google news অনুসরণের জন্য ক্লিক করুন

মোঃ নূরে আলম, সাব এডিটর : বাংলাদেশের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, অবকাঠামো উন্নয়ন, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশক্তি দৃঢ়ীভূত হয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড-১৯ মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে দেশটির অর্থনীতির সামনেও নানাবিধ সমস্যা উঠে এসেছে। এই নিবন্ধটি বাংলাদেশ অর্থনীতির গত পাঁচ বছরের উত্থান-পতন, প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সমাধানের সম্ভাব্য পথগুলো নিয়ে একটি অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করবে।

উত্থানের গতিপথ: অর্থনৈতিক অগ্রগতির ঝলক

রপ্তানি আয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে 

বাংলাদেশের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। 
এই অগ্রগতির প্রধান দিকগুলো হলো:

রপ্তানি আয় বেড়েছে: ২০১৮ সালে রপ্তানি আয় ছিল ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হলো তৈরি পোশাক খাতের দ্রুতগতির বিকাশ এবং নতুন রপ্তানি বাজার উন্মোচন।

অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে: সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে দেশের অবকাঠামোর মান উন্নত হয়েছে।

দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে: ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২১.৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৩.৮ শতাংশে।

এই অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২ শতাংশ, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

রপ্তানি আয় বৃদ্ধি: তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এই খাতের মাধ্যমে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে। গত পাঁচ বছরে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় দ্বিগুণ হয়েছে। এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হলো বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা বৃদ্ধি। এছাড়াও, সরকারের প্রণোদনা এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচির কারণে তৈরি পোশাক খাত আরও গতিশীল হয়েছে।

অবকাঠামো উন্নয়ন: সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশের অবকাঠামোর মান উন্নত হয়েছে। এই উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে পণ্য পরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। এছাড়াও, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দারিদ্র্য হ্রাস: দারিদ্র্য হ্রাস বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অর্জন। গত পাঁচ বছরে দারিদ্র্যের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই হ্রাসের পেছনে প্রধান কারণ হলো কৃষি খাতের উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির ব্যাপক বিস্তার এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির শক্তিশালীকরণ। কৃষি খাতের উন্নয়নের ফলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সক্ষম হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে, যা তাদের দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করেছে।

এই অগ্রগতিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক লক্ষণ। তবে, সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড-১৯ মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ অর্থনীতি গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশটির অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড-১৯ মহামারী এবং জলবায়ু পরিবর্তন সহ বেশ কিছু বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে পতনের মুখে পড়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট : ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটের ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, শ্রমবাজারের অস্থিরতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এই সংকটের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হ্রাস পেয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারী : ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও, মহামারীর কারণে দেশে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফসলের ফলন হ্রাস পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

সমাধানের সম্ভাব্য পথ

বাংলাদেশ অর্থনীতির পতনের কারণগুলি মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। 

এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে:
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব মোকাবেলায় রপ্তানি খাতে নতুন বাজার উন্মোচন, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের উন্নয়ন।
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা।
এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনীতির পতনের ধারাকে রোধ করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে।

Leave Your Comments